পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগ লক্ষণ ও প্রতিকার

 

 

 

পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগ লক্ষণ ও প্রতিকার

পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগ লক্ষণ ও প্রতিকার, পেপটিক আলসার মিথ, আলসারেটিভ কোলাইটিস কখন অপারেশন প্রয়োজন,
পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসার

গ্যাস্ট্রিক বা আলসার নামটির সাথে পরিচিত নন এমন লোক খুঁজে বের করা হয়তো খুব কঠিন হবে। সাধারণত লোকজন গ্যাস্ট্রিক বা আলসার বলতে যা বুঝিয়ে থাকেন আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলি পেপটিক আলসার।

পেপটিক আলসার যে শুধু মাত্র পাকস্থলীতেই হয়ে থাকে তা কিন্তু নয় বরং এটি পৌষ্ঠিক তন্ত্রের যেকোনো অংশেই হতে পারে। সাধারণত পৌষ্ঠিক তন্ত্রের যে যে অংশে পেপটিক আলসার দেখা যায় সে গুলো হচ্ছে-

০ অন্ননালীর নিচের প্রান্ত

০ পাকস্থলী

০ ডিওডেনামের বা ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশ এবং

০ পৌষ্ঠিক তন্ত্রের অপারেশনের পর যে অংশে জোড়া লাগানো হয় সে অংশে। পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশ তথা আমাদের এ উপমহাদেশে এ রোগীর সংখ্যা খুবই বেশি। ধনীদের চেয়ে গরীব লোকদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা দেয়। তবে নারী পুরুষ প্রায় সমানভাবে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

যে সব কারণে পেপটিক আলসার হতে পারে

০ বংশগত : কারো নিকটতম আত্মীয় স্বজন যেমন- মা, বাবা, চাচা, মামা, খালা, ফুফু যদি এ রোগে ভুগে থাকেন তবে তাদের পেপটিক আলসার হবার ঝুঁকি বেশি থাকে। যাদের রক্তের গ্রুপ ‘ও’ তাদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি।

০ রোগ-জীবাণু : হেলিকো বেক্টার পাইলোরি নামক এক প্রকার অণুজীব এ রোগের জন্য বহুলাংশে দায়ী।

০ ঔষধ : যে সমস্ত ঔষধ সেবনে পেপটিক আলসার হতে পারে তন্মধ্যে ব্যথানাশক ঔষধ বা ঘ ঝঅওউঝ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

০ ধূমপান : ধূমপায়ীদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি।

এছাড়াও কারো পৌষ্ঠিকতন্ত্র থেকে যদি বেশি পরিমাণে এসিড এবং প্রোটিন পরিপাককারী এক ধরনের এনজাইম বা পেপসিন নামে পরিচিত তা নিঃসৃত হতে থাকে এবং জন্মগতভাবেই পৌষ্ঠিকতন্ত্রের গঠনগত কাঠামো দুর্বল থাকে তাহলে ও পেপটিক আলসার হতে পারে।

তবে সাধারণত যে কথাটা প্রচলিত ভাজা-পোড়া কিংবা ঝাল জাতীয় খাবার খেলে পেপটিক আলসার হয় এর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ চিকিৎসা বিজ্ঞানে মেলেনি। তবে যারা নিয়মিত আহার গ্রহণ করেন না কিংবা দীর্ঘ সময় উপোস থাকে তাদের পেপটিক আলসার দেখা দিতে পারে।

উপসর্গ সমূহ

০ পেটে ব্যথা : সাধারণত পেটের উপরি ভাগের মাঝখানে বক্ষ পিঞ্জরের ঠিক নিচে পেটিক আলসারের ব্যথা অনুভব হয়। তবে কখনো কখনো ব্যথাটা পেছনের দিকেও যেতে পারে।

ক্ষুধার্ত থাকলে ব্যথা : এ জাতীয় রোগী ক্ষুধার্ত হলেই প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে এবং খাবার খেলে সাথে সাথে ব্যথা কমে যায়।

০ রাতে ব্যথা : অনেক সময় রাতের বলা পেটে ব্যথার কারণে রোগী ঘুম থেকে জেগে উঠে কিছু খেলে ব্যথা কমে যায় এবং রোগী আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

০ মাঝে মধ্যে ব্যথা : পেপটিক আলসারের ব্যথা সাধারণত সবসময় থাকে না, একাধারে ব্যথাটা কয়েক সপ্তাহ চলতে থাকে তারপর রোগী সম্পূর্ণরূপে ভাল হয়ে যায়, এ অবস্থা কয়েকমাস থাকে তারপর আবার কয়েক সপ্তাহ ধরে ঠিক আগের মতো ব্যথা অনুভব হয়।

০ ব্যথা কমে : পেপটিক আলসার ব্যথা সাধারণত দুধ, এন্টাসিড, খাবার খেলে কিংবা বমি করলে অথবা ঢেকুর তুললে কমে।

এ ছাড়াও পেপটিক আলসারের রোগীদের মধ্যে বুক জ্বালা, অরুচি, বমি বমি ভাব, ক্ষুধা মন্দা, কিংবা হঠাৎ করে রক্ত বমি অথবা পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হতে পারে।

চিকিৎসা

০ শৃংখলা : পেপটিক আলসারে আক্রান্ত রোগীদের অবশ্যই ধূমপান বন্ধ করতে হবে। ব্যথা নাশক ঔষধ অর্থাৎ এসপ্রিন জাতীয় ঔষধ সেবন থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে এবং নিয়মিত খাবার গ্রহণ করতে হবে।

০ ঔষধ : পেপটিক আলসারের রোগীরা সাধারণত এন্টাসিড, রেনিটিডিন, ফেমোটিডিন, ওমিপ্রাজল, লেনসো প্রাজল, পেনটো প্রাজল জাতীয় ঔষধ সেবনে উপকৃত হন।

০ কারণভিত্তিক চিকিৎসা : জীবাণু জনিত কারণে যদি এ রোগ হয়ে থাকে তবে বিভিন্ন ঔষধের সমন্বয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয় যা ট্রিপল থেকে থেরাপি নামে পরিচিত।

০ অপারেশন : পেপটিক আলসারের ক্ষেত্রে অপারেশন সাধারণত জরুরি নয়। তবে দীর্ঘ মেয়াদী ঔষধ সেবনের পরও যদি রোগী ভাল না হন, কিছু খেলে যদি বমি হয়ে যায় অর্থাৎ পৌষ্ঠিক নালীর কোনো অংশ যদি সরু হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে অপারেশন করিয়ে রোগী উপকৃত হতে পারেন।

সময় মত পেপটিক আলসারের চিকিৎসা না করলে রোগীর নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে। যেমন-

০ পাকস্থলী ফুটা হয়ে যেতে পারে

০ রক্ত বমি হতে পারে

০ কালো পায়খানা হতে পারে

০ রক্তশূন্যতা হতে পারে

০ ক্যান্সার হতে পারে (কদাচিং) এবং

০ পৌষ্টিক নালীর পথ সরু হয়ে যেতে পারে এবং রোগীর বার বার বমি হতে পারে।

কাজেই যারা দীর্ঘমেয়াদী পেপটিক আলসারে ভুগছেন তাদের উচিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। পেপটিক আলসার জনিত জটিলতা আগে থেকেই শণাক্ত করা এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা নেয়া, প্রয়োজনে অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা ধরে না রেখে সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবন যাপন করা।

০ অধ্যাপক ডা. একেএম ফজলুল হক

লেখক : চেয়ারম্যান, কলোরেকটাল সার্জারি বিভাগ (অবঃ), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

চেম্বার : জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হাসপাতাল, ৫৫, সাত মসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা। ফোন : ০১৭১৫০৮৭৬৬১, ০১৭২৬৭০৩১১৬।

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুলাই ২৫, ২০০৯

পেপটিক আলসার মিথ

অনেকের ধারণা, ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবারের কারণে পেপটিক আলসার হয়। ধারণাটি ভুল, বরং ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার পেপটিক আলসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।

সলাযুক্ত খাবার খেলে কখনো কখনো বুক জ্বালাপোড়া করতে পারে, এই বুক জ্বালাপোড়া হয় মসলায় থাকা ক্যাপসেইসিনের কারণে। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, ক্যাপসেইসিনের কারণে পেপটিক আলসার হয় না।

সিঙ্গাপুরে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কম মসলাযুক্ত খাবার খায় তারা, যারা বেশি মসলাযুক্ত খাবার খায় তাদের তুলনায় তিন গুণ বেশি পেপটিক আলসারে আক্রান্ত হয়েছে। মসলাযুক্ত খাবারের কারণে পাকস্থলীর অম্লতা পরিবর্তিত হয়, ফলে পাকস্থলীতে আলসার তৈরিকারক ব্যাকটেরিয়া হেলিকব্যাক্টর বাঁচতে পারে না।

মো. রওশন আলী

অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান মেডিসিন, মেডিকেল কলেজ ফর ওমেন অ্যান্ড হসপিটাল

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১২

আলসারেটিভ কোলাইটিস কখন অপারেশন প্রয়োজন

পূর্বে ইউরোপ ও আমেরিকাতে এ রোগ দেখা গেলেও উপমহাদেশের জনগণের মধ্যে ছিল কদাচিত। তবে বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর খাদ্যাভাস ও সংস্কৃতি অনুকরণের ফলে আমাদের দেশের জনগণের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে আলসারেটিভ কোলাইটিস। এ রোগটি সাধারণত ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মাঝামাঝি লোকজনের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। আলসারেটিভ কোলাইটিস ঠিক কাদের হয় তার কারণ সটিকভাবে জানা যায়নি। তবে মামাত, চাচাত, খালাত ও পুফাত ভাই-বোনদের সন্তানদের মধ্যে এ রোগ দেখা দিতে পারে। তবে কেউ কেউ মনে করেন কোলনের অন্ত্রগাত্রের আবরণ যদি দুর্বল হয় তবে এ রোগ হতে পারে। কেউ যদি খুবই দুশ্চিন্তায় ভোগে, দুধ কিংবা দুগ্ধজাতীয় খাবার খায় অথবা আমাশয়ে ভোগে তবে আলসারেটিভ কোলাইটিসের উপসর্গগুলো বারবার দেখা দিতে পারে।

উপসর্গগুলো : ১. ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হওয়া। ২. পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া। ৩. অনেক সময় এমনিতেই মলদ্বার দিয়ে মিউকাস কিংবা আম জাতীয়। পদার্থ বের হওয়া। ৪. রক্ত যাওয়া। ৫. তল পেটে মোচড় দেয়া এবং সাথে সাথে প্রচণ্ড পায়খানার বেগ অনুভব হওয়া। ৬. সময়মতো বাথরুমে যেতে না পারলে। ৭. পায়খানা হয়ে কাপড় নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং। ৮. ঘন ঘন পাতলা পায়খানা ও রক্ত যাওয়া ফলে রোগীর পানি, লবণ এবং রক্তশূন্যতা দেখা দেয়া ইত্যাদি।

সময়মতো চিকিৎসা না করলে কী হতে পারে

১. কোলনে ক্যান্সার হতে পারে

২. দেহের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে, যেমন-কোমড়ে, মেরুদণ্ডে, হাঁটুতে, পায়ের গোড়ালীতে, হাতের জয়েন্টে;

৩. চামড়ার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লাল দাগ অথবা আলাসর হতে পারে;

৪. চোখের বিভিন্ন ধরনের প্রদাহজনিত রোগ হয়ে অন্ধ হয়ে যেতে পারে;

৪. চোখের বিভিন্ন ধরনের প্রদাহজনিত রোগ হয়ে অন্ধ হয়ে যেতে পারে;

৫. মুখ, হাত ও পায়ে পানি এসে শরীর ফুলে যেতে পারে এবং

৬. জন্ডিস হতে পারে, লিভারের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয় লিভার নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

চিকিৎসা : ওষুধ: সাধারণত স্টেরয়েড ও সালফাসেলজিন জাতীয় ওষুধ দিয়ে এ রোগের চিকিৎসা করা হয় তবে মাঝেমধ্যে হাইড্রোকরর্টিসন, এজাথায়েপ্রিন অথবা সাইক্লোসপোরিন ব্যবহার করলে অনেকের মুখ ও শরীর ফুলে যেতে পারে, মাথার চুল পড়ে যেতে পারে, অনিদ্রা, অরুচি, হাতে-পায়ে জ্বালা-পোড়া, বমি বমি ভাবসহ নানাবিধ পারীরিক অসুবিধা হতে পারে।

অপারেশন : আলসারেটিভ কোলাইটিসের স্থায়ী চিকিৎসা হতে পারে অপারেশন, তবে সব রোগীর ক্ষেত্রে অপারেশনের দরকার হয় না।

যেসব ক্ষেত্রে অপারেশন প্রযোজ্য

১. রোগীর অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন হলে, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ ব্যবহারের পরও কোনো উন্নতি হয় না। ২. রোগীর যদি ঘন ঘন পায়খানায় যেতে যেতে হাঁপিয়ে ওঠেন, পায়খানা ধরে রাখতে না পারেন কিংবা রক্তশূন্যতায় ভোগেন। ৩. দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড ব্যবহার করার পরো যখন স্টেরয়েড আর কাজ করে না বরং স্টেরয়েড ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। ৪. কোলনোস্কপি বা সিগময়ডোস্কোপি করার পর যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে।

এ অপারেশনের পর পেটে স্থায়ীভাবে মলত্যাগের ব্যাগ লাগাতে হবে কি না এটি একটি বড় প্রশ্ন। আজকাল জটিল বিশেষ ধরনের অপারেশন করে পেটে স্থায়ী মলত্যাগের ব্যাগ (আইলিওস্টমি) না লাগিয়েও অপারেশন করা যায়। এ অপারেশন করতে দীর্ঘ সময় লাগে এবং বিশেষভাবে পারদর্শিতার প্রয়োজন হয়।

অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হক

লেখক : বৃহদান্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি বিশেষজ্ঞ, চেয়ারম্যান (অবঃ),

কালোরেকটাল সার্জারি বিশেষজ্ঞ, চেয়ারম্যান, কলোরেকটাল সার্জারি,

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

চেম্বার : জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, ৫৫ সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা।

ফোন : ০১৭২৬৭০৩১১৬,০১৭১৫০৮৭৬৬১

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, অক্টোবর ৩১, ২০০৯

বাংলাদেশে অবসরপ্রাপ্তদের জন্য অনলাইন আয়ের কৌশল: ঘরে বসে কীভাবে অর্থ উপার্জন করা যায়